শাহরিয়ার নাসের: কখনো গ্রামের মেঠোপথ, কখনো শহরের অলিগলি। আর সঙ্গী দুই চাকার বাহন সাইকেল। পা দিয়ে প্যাডেল ঘুরিয়ে ভূ দৌড়। কি আনন্দ! বলা চলে আমার এক সময়ের অন্যতম নিত্যসঙ্গী সাইকেল। শৈশব আর কৈশোরের নানা বিষয় যখনই স্মৃতিচারণ করতে যাই তখনই স্মৃতিতে ভেসে ওঠে আমার ‘হিরো’ সাইকেলের কথা।
যখন কৌতূহলের বিষয় ‘সাইকেল’
সাইকেল চালানো শেখাটা আমার খুব ছোটবেলায়। এটা শেখা নিয়ে আমার কৌতূহলের অন্ত ছিলনা। কারো সাইকেল দেখলেই নিয়ে দিতাম এক দৌড়। এখনো সব আমার চোখে ভাসে৷ হাসপাতালে আমি সঙ্গে আমার বাবা। আমার এক হাতে ব্যান্ডেজ। আর ব্যান্ডেজের কারণ সাইকেল। একবার আমার আপু আমাকে নিয়ে ওঠে সাইকেলে। উদ্দেশ্য ছিল সাইকেল চালানো শিখব। ফলাফল আমার ভাঙা হাত নিয়ে আমার বাবাকে যেতে হয় হাসপাতালে। কিন্তু আমার শেখার প্রচেষ্টা বিন্দুমাত্র কমেনি। তখন ওপরে নয় নিচে চালানোর চেষ্টা করতাম। শিখব শিখবই এমনই দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম। কবি কালীপ্রসন্ন ঘোষের পারিব না কবিতার দু’লাইন এখানে বলতে হয়-
‘জলে না-নামিলে কেহ শিখে না সাঁতার,
হাঁটিতে শিখে না কেহ না-খেয়ে আছাড়…’
এই আছাড় খেতে খেতেই আমার সাইকেল চালানো শেখা। সাইকেল যেমন আছাড় খেয়ে শিখেছি তেমনি সাঁতারও শিখেছি পানি খেয়ে। সাঁতার রপ্ত করার পেছনেও লম্বা গল্প আছে। সেটি লিখব অন্যদিন।
আমাদের ছিল তিন তিনটা ‘সাইকেল’
ছোটবেলা থেকেই সাইকেল দেখে বড় হচ্ছি৷ আমাদের ছিল তিন তিনটা সাইকেল। আমার বাবাও নিয়মিত সাইকেল চালাতেন। বাবার উচ্চ রক্তচাপ। বাবা বলতেন, সাইকেল চালালে শরীর ভালো থাকে। একটি সাইকেল ছিল বাবার আর অন্য দুটি আমাদের। একটি আমার ইমিডিয়েট সহোদর ভাইয়ের আর অন্যটি আমার সেজো ভাইয়ের। বাবা চালাতো ফনিক্স, সেজো ভাই হিরো আর অ্যাভন ছিল ইমিডিয়েট সহোদরের। সাইকেল নষ্ট হলে বাজার থেকে মেরামত করে নিয়ে আসতেন বাবা। টুকটাক মেরামত যেমন হাওয়া দেওয়া, নাট-বল্টু টাইট দেয়া এই কাজগুলো অনেকসময় নিজেই করতাম। বাবা যন্ত্রপাতি কিনে রেখেছিলেন।
যেভাবে হিরো সাইকেলটার মালিক হলাম
পঞ্চম শ্রেণী শেষ করে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হই টাংগাইলের মধুপুর শহীদ স্মৃতি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। আমার ইমিডিয়েট সহোদরও একই স্কুলে ভর্তি হয়। আপন এলাকা ছেড়ে সেখানে মন বসেনি কারো। হু হু করে মনটা কেঁদে ওঠতো জন্মভূমির জন্য। আর তাই সব ছেড়ে আবার চলে আসি আপন এলাকায়। সাইকেলের প্রতি ভালোবাসাটা আমার ঠিক তখনই বেশি করে শুরু হয়। সেজো ভাই উচ্চমাধ্যমিকে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ভর্তি হওয়ার পর আমি হিরো সাইকেলটার মালিক হয়ে যাই।
বন্ধুদের সঙ্গে পাশাপাশি সাইকেল চালানো
একদিন বাড়ির আঙিনা পেরিয়ে মেইন রোডে সাইকেল চালাতে শিখি। ডাবলিং করাটাও রপ্ত করি। কেটে যায় সব ভয়। নানা গল্প করতে করতে বন্ধুদের নিয়ে একসঙ্গে সাইকেল চালিয়ে মনের সুখে ক্লাস, কোচিং, প্রাইভেটসহ অনেককিছু করেছি। শীতের সকালে সাইকেল চালানোটা ছিল আরো মজার৷ কুয়াশার বুক ভেদ করে প্যাডেল দিতে দিতে চলে যেতাম কোচিংয়ে। খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠতাম। বাবা খাবার প্রস্তুত করতেন। গরম খাবার খেয়ে চলে যেতাম কোচিংয়ে। এরপর আবার প্রাইভেট, স্কুল। সব জায়গায়ই যেতাম এই এক সাইকেল দিয়ে। আমার বন্ধু মাজহার, আকাশ, মামুন তাদের কথা মনে পড়ে৷ আমরা একসঙ্গেই যেতাম বেশিরভাগ সময়।
এক্সিডেন্ট যখন স্মৃতি
একদিন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আমার সাইকেল ধাক্কা দেয় গার্লস স্কুলে পড়ুয়া এক মেয়েকে। আমি পড়তাম বয়েজ স্কুলে আর মেয়ে পড়তো গার্লস স্কুলে। এক্সিডেন্ট করে দুঃখ প্রকাশ করে মুক্তি পেলেও বন্ধুদের দুষ্টামি থেকে মুক্তি পাইনি। আমি যেই সড়ক দিয়ে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যেতাম৷ ওই মেয়েও একই সড়ক দিয়ে স্কুলে যেত। আর বন্ধুরা মজা করতো আর বলত, ওই মেয়ের সঙ্গে আমার প্রেম-ভালোবাসা হোক।
সাইকেল দেখলে মন ফিরে যায় অতীতে
এখনও কারো সাইকেল যখনই দেখি একটু চালাতে মন চায়। আর চালানোর মধ্য দিয়ে ফিরে যাই আমার দূরন্ত শৈশবে। এইতো বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ক’দিন আগেও এক ছোটভাইয়ের সাইকেল নিয়ে পুরো ক্যাম্পাস চক্কর দিয়েছি। অতীত যেমন আমি ভুলতে পারব না কখনো, ঠিক তেমনি আমার সাইকেল স্মৃতিও কখনো ভুলতে পারব না। এখনও মনে পড়লে আমি আবেগপ্রবণ হয়ে যাই। আমাদের সাইকেলগুলোকে খুঁজে ফিরি। আমার সেই হিরো সাইকেলটা খুঁজি। আমার সেই হিরো সাইকেল কই! এমন প্রশ্ন জাগে মনের মধ্যে। বড্ড বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে যাই৷ সাইকেল আমি ছাড়লেও সাইকেল আমাকে ছাড়েনি। সাইকেল আজীবন স্মৃতি হয়ে থাকুক আমার সঙ্গে।
লেখক: শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মী,নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।


