২২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুটেক্স) ১৩তম জন্মদিন তথা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। যাত্রার প্রাক্কাল থেকে বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টি উচ্চশিক্ষায় একটি দৃঢ় ও মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে এসেছে।
বুটেক্স থেকে গ্রাজুয়েট প্রতিবছর বস্ত্র প্রকৌশলী দেশের বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে প্রবেশ করছে। আজকের এই বুটেক্সের যাত্রা শুরু হয়েছিলো ১৯২১ সালে। ঢাকার নারিন্দাতে তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনামলের সময় টেক্সটাইলের উপর কারিগরি শিক্ষা প্রদানের উদ্দেশে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘দি ব্রিটিশ স্কুল অব উইভিং ‘। কালের পরিক্রমায় দেশের অর্থনীতিতে তৈরি পোশাক শিল্পের গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকার ২০১০ সালে একে বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করেন এবং ২০১১ সালের ১৫ মার্চ একে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে চালু করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়টির ১৪তম বছরে পদার্পণ উপলক্ষে সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা তুলে ধরছে সংবাদ লাইভ টুয়েন্টিফোর ডটকমের বুটেক্স প্রতিনিধি মো. রাফি সারোয়ার।
টেক্সটাইল ফ্যাশন অ্যান্ড ডিজাইন বিভাগের ৪৮ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী নাদিরা সুলতানা জ্যোতি বলেন, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়, যা উৎপাদনকেন্দ্রিক ও শিল্পায়নমুখী বস্ত্রপ্রকৌশল শিক্ষায় বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র সরকারি টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাণের এই বিদ্যাপীঠের ১৪ বছর পদার্পণের সাক্ষী হতে পেরে আমি অত্যন্ত গর্বিত । বিশ্ববিদালয়টির আয়তন ছোট হওয়ায় প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মধ্যে রয়েছে বন্ধুসুলভ আচরণ ও মিলবন্ধন । করোনা মহামারির কারণে উদ্ভূত সেশন জটের সমস্যা বুটেক্স প্রশাসন অত্যন্ত সফলতা ও বিচক্ষণতার সাথে সমাধান করেছে । প্রাপ্তির খাতায় প্রতিনিয়তই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন নতুন অর্জন যুক্ত হচ্ছে। ডিজিটাল ক্লাসরুম , নিরাপদ ক্যাম্পাস , স্বাস্থকর কান্টিন প্রতিষ্ঠা এবং নতুন নতুন গবেষণা পত্র প্রকাশের মাধ্যমে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মান বর্ধিত হচ্ছে । এছাড়াও সাংস্কৃতিক , সংগঠনিক ও শিক্ষামূলক কার্যক্রমেও বরাবরই অনেকটা এগিয়ে রয়েছে বুটেক্স । সামনের দিন গুলোতেও বুটেক্সের এই সাফল্য ধারা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে দেশ বিদেশেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যময় খ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে।
ওয়েট প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থী রাতুল সাহা বলেন, বাংলাদেশে টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সকলকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই। বস্ত্র প্রকৌশল শিক্ষায় অনন্য এক মুখ বুটেক্স। ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগের বিশ্ব পরিচিত করতে এটি যে অসামান্য অবদান রেখে চলেছে তা আমাদের সকলেরই জানা। এর ফলে ছোট ও প্রাণের ক্যাম্পাস বুটেক্স থেকে আমার প্রত্যাশা ও বেশি।
তিনি আরও বলেন, প্রতিষ্ঠার এত বছর পরেও বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে নানান ধরনের সংকট ও অনিয়ম। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এগিয়ে যাওয়ার পেছনে যেটি সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে তা হলো ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা খাত। তাই বুটেক্সর গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া সত্ত্বেও বুটেক্সের ওয়েবসাইট মানসম্মত ও আধুনিক নয়। বিশ্ববিদ্যালয়টির লাইব্রেরিতে নেই চাহিদা মাফিক বই। চিকিৎসা কেন্দ্রে পাওয়া যায় না মানসম্মত ও জরুরী চিকিৎসা সেবা। সার্টিফিকেট তোলার ক্ষেত্রে ভোগান্তিতে পড়তে হয় শিক্ষার্থীদের। এ সমস্যার খুব দ্রুত সমাধান আসা জরুরি। এছাড়া আবাসিক হল গুলোতে শিক্ষার্থীরা পাচ্ছে না পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা। সকল আবাসিক হল গুলোতে দ্রুতগতির ওয়াইফাই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ডাইনিং এবং ক্যান্টিনে ভর্তুকি ব্যবস্থা করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা মানসম্মত খাবার খেতে পারে। আশা করি এসব সংকট নিরসনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রসাশন খুব শীঘ্রই পদক্ষেপ নিবেন এবং অপূর্ণতা গুলো কাটিয়ে এগিয়ে যাবে বুটেক্স। বঙ্গবন্ধুর কাঙ্খিত সোনার বাংলা ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে আগামী দিনেও ভূমিকা রাখতে পারবে আমাদের প্রিয় বুটেক্স।
ওয়েট প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মো: সোয়াদ আবেদিন সিয়াম বলেন, আকারে মাত্র ১২ একর হলেও সেখান থেকেই বাংলাদেশের ৩০ বিলিয়ন ডলার পোশাক খাতের জন্য মানসম্পন্ন বস্ত্র প্রকৌশলী তৈরি করছে বুটেক্স। তাই বুটেক্সে এ অধ্যয়নের সুযোগ পেয়ে আমি গর্বিত। বুটেক্স ক্যাম্পাসে আমার স্বল্প দিনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি এটা উপলব্ধি করতে পেরেছি যে আমাদের ক্যাম্পাস সম্পূর্ণ র্যাগিংমুক্ত এবং আমাদের রয়েছে অসংখ্য সহ শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সুযোগ। কিন্তু করোনাকালীন বাধার কারণে কিছুটা সেশনজট তৈরি হলেও আমাদের শিক্ষার্থীসুলভ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের চেষ্টায় সেটা প্রায় সমাধানের পথে। আশা করি আগামীতে এই সমস্যা সম্পূর্ণ সমাধান হয়ে যাবে। তাই বুটেক্স দিবসে আমার প্রত্যাশা সকল বাধা অতিক্রম করে আগামীতেও বাংলাদেশ মানসম্পন্ন বস্ত্র প্রকৌশলী তৈরিতে বুটেক্স অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
এনভায়রনমেন্ট সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থী রোমিনুর রহমান তালুকদার বলেন, বুটেক্স দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে একমাত্র পাবলিক টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় । প্রতি বছর শত শত মেধাবী শিক্ষার্থীরা এখানে পড়াশোনা শেষ করে দেশের টেক্সটাইল সংক্রান্ত বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিতে তাদের মূল্যবান অবদান রেখে চলেছে।একজন ছাত্র হিসেবে আমি এই বুটেক্সের অংশ হতে পেরে আসলেই খুব গর্বিত।
তিনি আরও বলেন, ১১.৫৭ একর অথবা ৪.৬৮ হেক্টরের খুবই ছোট্ট আমাদের এই বুটেক্স প্রাঙ্গন। অনেকের শুরুতে মন খারাপ হয়ে থাকে বিশ্ববিদ্যালয় ছোট হওয়ার কারণে। কিন্তু দিন যত যায় এই ছোট্ট ঘরটার প্রতি সবার ভালোবাসা বাড়তে থাকে। বুটেক্সে আছে হরেক রকম ল্যাব ফ্যাসিলিটিস, আছে খেলার জন্য ছোট একটি মাঠ, ব্যবহারিক জীবনে একজন শিক্ষার্থী যেন পিছিয়ে না পরে সেজন্য রয়েছে নানা ধরনের টেক্সটাইল রিলেটেড ব্যবহারিক কোর্স সমূহ।
অনেক সুবিধার পাশাপাশি রয়েছে কিছু অসুবিধা সমুহ।প্রতিটা শ্রেণিকক্ষে মাল্টিমিডিয়ার যথাযথ প্রয়োগ এখনো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সুনিচ্শিত করতে পারে নি। আমাদের শিক্ষার্থীদের অনেকেরই রিসার্চের প্রতি প্রবল আগ্রহ থাকে। কিন্তু এখানে নেই তেমন কোনো ক্লাব, যার মাধ্যমে তারা সহযোগিতা বা উৎসাহ পেতে পারে। তাই একটি ‘রিসার্চ ক্লাব’ খোলার জোর দাবি জানাচ্ছি।
সকল অসুবিধাগুলো দূরীকরনের মাধ্যমেই বুটেক্স তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
ইয়ার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ফাহাদ ইমন বলেন, ভর্তি হতে এসেছিলাম দক্ষিন এশিয়ার একমাত্র পাবলিক টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় যেটা বুটেক্স নামে অধিক পরিচিত। ভর্তির দিনই এই ক্যাম্পাসে প্রথম আসা। এতো ছোট ক্যাম্পাস দেখে মন এতোটাই খারাপ হয়েছিল যেটা বলে প্রকাশ করা সম্ভব না। আশা ছিল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বো, অনেক বড় ক্যাম্পাস হবে, বন্ধুদের নিজের ক্যাম্পাসে এনে সবকিছু ঘুরিয়ে দেখাবো। কিন্তু এখানে এসে দেখলাম ক্যাম্পাস শুরু না হতেই শেষ। তবে এই খারাপ লাগাটা বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। ক্লাস শুরু হওয়ার পর থেকে নিয়মিত ক্যাম্পাসে আসা যাওয়া শুরু হয়। আস্তে আস্তে ক্যাম্পাসের প্রতি ভালোলাগা কাজ করে। হলে উঠার পরে এই ভালো লাগাটা আরো বেড়ে যায়। দিনের বেশিরভাগ সময় এই ক্যাম্পাসেই থাকি। ক্যাম্পাসটা ধীরে ধীরে একটা আবেগের জায়গায় পরিণত হয়ে যায়। তবে কিছু বিষয় নিয়ে কথা না বললেই নয়। ডিজিটাল বাংলাদেশের এই যুগে যেখানে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রক্রিয়া, সাবজেক্ট চয়েজ ইত্যাদি অনলাইনে হয়ে থাকে। সেখানে বুটেক্স এখনো এনালগ যুগে পড়ে আছে। তাছাড়া এই ছোট ক্যাম্পাসের ছাত্র সংসদের সামনে রাস্তা এবং স্পিনার্স ক্লাবের সামনের রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ। সংসদের সামনের রাস্তায় তো হালকা বৃষ্টি হলেই পানি উঠে যায়।তাছাড়া বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পোশাক খাতের অবদান সবারই জানা। আর এই পোশাকখাতে বুটেক্সিয়ানদের একক আধিপত্য রয়েছে প্রথম থেকেই। কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো এই বুটেক্সে এখন পর্যন্ত কোনো সমাবর্তনের আয়োজন করা হয় নি। এই ব্যাপারটা প্রতিটা বুটেক্সিয়ান জন্য হতাশাজনক। তবে আমরা অত্যন্ত আশাবাদী যে কতৃপক্ষ এই বিষয়গুলোর উপর সুনজর দিবেন। শুধু সমস্যার কথা বললেই তো হবে না। বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষের কিছু সিদ্ধান্ত আসলেই প্রশংসার দাবিদার। এইতো কিছুদিন আগে বুটেক্স স্কলারশিপ অফিস চালু করেছে যেটা শিক্ষার্থীদের স্কলারশিপের জন্য খুবই সাহায্যকারী প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে। দেশ ও দেশের বাহিরে বুটেক্সিয়ানরা যেভাবে ভূমিকা রাখছে, এটা আমাদের জন্য আসলেই গর্বের বিষয়। আমরা চাই বুটেক্স এগিয়ে যাক সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
টেক্সটাইল ফ্যাশন অ্যান্ড ডিজাইন বিভাগের ৪৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ফারহানা জামান তিথি বলেন, এটি শুধুমাত্র একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, দেশের টেক্সটাইল শিল্পের প্রানকেন্দ্র। ২০১০ সালে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানের রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস। স্বাধীনতার পর ঢাকা টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট নামে পথচলা শুরু করে আজ সেই গৌরবময় যাত্রা অব্যাহত রয়েছে ‘বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়’ হিসেবে।
বুটেক্স কেবল স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ডিগ্রি প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান নয়, গবেষণা ও উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু। টেক্সটাইল প্রকৌশল, ফ্যাশন ডিজাইন, টেক্সটাইল ম্যানেজমেন্ট, টেক্সটাইল কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-সহ নানা শাখায় দক্ষ জনবল তৈরি করা হয় এখানে। আধুনিক গবেষণাগার, যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকমণ্ডলী, শিল্পাঞ্চলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের ফলে শিক্ষার্থীরা শুধুই তাত্ত্বিক জ্ঞান নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতাও অর্জন করে।
যদিও সব বুটেক্সিয়ান দের একটাই আক্ষেপ যে আমাদের ক্যাম্পাস ছোট কিন্তু ক্যাম্পাসের প্রতিটা দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতি ছোট এই ক্যাম্পাসের সৌন্দর্যকে করেছে আরো অর্থবহ এবং আকর্ষণীয়। একদিকে দক্ষ জনবল সরবরাহ অন্যদিকে গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে উৎপাদন মান উন্নত করে বুটেক্স দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অপরিসীম।
‘জ্ঞানই শক্তি’ নীতিবাক্য ধারণ করে বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় শুধুই শিক্ষার্থী তৈরি করছে না, গড়ে তুলছে দক্ষ, উদ্ভাবনী মানসম্পন্ন এক প্রজন্ম, যারা দেশের পোশাক শিল্পকে আরও সমৃদ্ধ করে তুলবে।
সংবাদ লাইভ/শিক্ষা


