‘যেতে নাহি দিব হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়’ এই অমোঘ সত্যের কাছে হার মেনে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক তামিম ইকবাল।
বৃহস্পতিবার (৬ জুলাই) চট্টগ্রামের এক হোটেলে সংবাদ সম্মেলন ডেকে অবসরের সিদ্ধান্ত জানান তামিম। এ সময় বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। সাগরিকায় আফগানিস্তানের বিপক্ষে চলমান সিরিজের মাঝেই তামিমের সিদ্ধান্তে অবাক হয়েছেন সতীর্থ ও দেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা।
গত মাস থেকে পিঠের পুরোনো চোট ভোগাচ্ছিল তামিমকে। সেই চোটে আফগানিস্তানের বিপক্ষে একমাত্র টেস্ট মিস করেছেন তিনি। এরপর কোচিং স্টাফদের সঙ্গে নিয়ে নেটে অনুশীলন করেছেন। তবে পুরোপুরি ফিট ছিলেন না এই ব্যাটার।
বুধবার (৫ জুলাই) চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে আফগান অধিনায়কের সঙ্গে টস করতে আসেন তামিম। যা মোটেও ভালোভাবে নেননি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন ও টাইগার কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে তামিমের এই অবসর বলে মনে করা হচ্ছে।
তামিম জানিয়েছেন, হুট করে সিদ্ধান্ত নেননি তিনি। কিছুদিন ধরে বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলেন। পরিবারের সঙ্গেও এটা নিয়ে কথা বলছিলেন।
হঠাৎই অবসরের ঘোষণার মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ১৬ বছরের বর্ণিল ক্যারিয়ারের ইতি টানলেন তামিম। এ সময়ের মধ্যে জাতীয় দলের জার্সিতে অনেক ঐতিহাসিক জয়ের সাক্ষী হয়েছেন তিনি। ক্রিকেট ক্যারিয়ারের প্রথম সূর্যদয় থেকে গোধূলি লগ্ন পর্যন্ত ব্যাট হাতে প্রতিপক্ষ বোলারদের একচেটিয়া শাসন করে গেছেন। দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করে গড়েছেন একের পর এক অনন্য রেকর্ড।
পুরো নাম তামিম ইকবাল খান। ১৯৮৯ সালের ২০ মার্চ চট্টগ্রামের সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। এরপর সেখানেই বেড়ে ওঠা।
তামিমের বয়স যখন আট বছর তখন আকরাম খানের নেতৃত্বে মালয়েশিয়াতে নতুন ইতিহাস রচনা করে বসেন লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফির ফাইনালে কেনিয়াকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো কোনো বৈশ্বিক শিরোপা জয়ের স্বাদ পায় বাংলাদেশ।
লাল-সবুজের জার্সিতে তামিমের চাচা আকরাম খান ও বড় ভাই নাফীস ইকবাল প্রতিনিধিত্ব করেছেন আগেই। তবে তাদের দেখে নয়, বরং বাবার স্বপ্ন পূরণ করতেই ক্রিকেটের জার্সি গায়ে তোলেন তামিম।
নিজের বাবার স্বপ্নপূরণের জন্যই ক্রিকেট খেলেছেন জানিয়ে তামিম বলেন, আমি শুধু একটি কথাই বলতে চাই— আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। এর পরই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার স্বপ্নে বিভোর চট্টলার এক তরুণ তুর্কি মনোযোগ দেন মাঠের ক্রিকেটে। এরপর স্থানীয় ক্রিকেট ক্লাব হয়ে দেশের ঘরোয়া লিগে পারফর্ম শুরু করেন। যার ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ জাতীয় দলের জার্সিতে সুযোগ আসে বাঁহাতি এক টগবগে তরুণের।
তামিমের জাতীয় দলের জার্সিতে ওয়ানডে দলে অভিষেক হয় ২০০৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারিতে। সেবার জিম্বাবুয়েতে সফর করে বাংলাদেশ। এ সফরে চার ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ খেলে টাইগাররা। যেখানে সিরিজের তৃতীয় ওয়ানডেতে বাংলাদেশের জার্সি গায়ে জড়ানোর সুযোগ আসে তামিমের। যেই সিদ্ধান্ত, সেই বাস্তবায়ন।
জিম্বাবুয়ের হারারে স্পোর্টস ক্লাবে হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ দলে অভিষেক হয় আরেক বাঁহাতি ওপেনার তামিম ইকবালের। অবশ্য নিজের অভিষেক ম্যাচটি রাঙাতে পারেননি। এদিন শাহরিয়ার নাফীসের সঙ্গে ওপেনিংয়ে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ৫ রানেই প্যাভিলিয়নের পথ ধরেন তিনি।
একই সিরিজের চতুর্থ ও শেষ ওয়ানডেতেও দলে সুযোগ পান তামিম। আর সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ব্যাট হাতে স্বাগতিক বোলারদের ওপর চড়াও হন। অবশ্য ত্রিশেই কাটা পড়েন তিনি। ওই ম্যাচে ৪০ মিনিট ক্রিজে থেকে দুটি ছক্কা ও তিনটি বাউন্ডারি হাকিয়েছিলেন। এরপর থেকে জাতীয় দলের নিয়মিত মুখ হয়ে ওঠেন এই ওপেনার।
জিম্বাবুয়ে মিশন শেষ করতে না করতেই উইন্ডিজে গড়ায় ওয়ানডে বিশ্বকাপের আসর। যেখানে প্রত্যাশিতভাবেই বাংলাদেশ স্কোয়াডে সুযোগ পান তামিম। বিশ্বকাপে স্মরণীয় কিছু করতে না পারলেও ক্রিকেটের পরাশক্তি ভারতকে হারিয়ে বেশ হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল বাশার-রফিকরা।
২০০৭ সালের ১৭ মার্চ। পোর্ট অব স্পেনে গড়িয়েছে ওয়ানডে বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের খেলা। যেখানে ভারতের মুখোমুখি বাংলাদেশ। এই ম্যাচে টস জিতে আগে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন ভারতের অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি।
এদিন মাশরাফী-রাজ্জাকের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে ৪৯.৩ ওভারে ১৯১ রানেই সব উইকেট হারায় ভারত। এতে টাইগারদের সামনে লক্ষ্য দাঁড়ায় ১৯২ রানের। জবাবে ব্যাট করতে নেমে শুরুতেই ভারতীয় বোলারদের ওপর চড়াও হন তামিম ইকবাল।
এই ম্যাচে জহির খানকে নাস্তানাবুদ করে ঝরো গতিতে রান তুলতে থাকেন তামিম। ফলে ৭ বাউন্ডারি ও দুই ছক্কায় ফিফটি স্পর্শ করেন তিনি। অবশ্য ফিফটির ইনিংস লম্বা করতে পারেননি। কিন্তু বাংলাদেশকে জয়ের পথ দেখিয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরেছিলেন এ বাঁহাতি।
পরে সাকিবের ফিফটি ও মুশির দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ে জয়ের বন্দরে পৌঁছে যায় লাল-সবুজের জার্সিধারীরা।
দ্বিপাক্ষিক সিরিজ ও বিশ্বমঞ্চে দুর্দান্ত পারফর্ম করে জাতীয় দলের অন্যতম সদস্য বনে যান তামিম। এরপর টাইগারদের হয়ে নিয়মিত ওপেনিং সামলানো শুরু করেন তিনি। ব্যাটকে ধারালো তরবারি বানিয়ে প্রতিপক্ষ বোলারদের শাসন করতে থাকেন বাংলাদেশের এই তরুণ তুর্কি।
ওয়ানডেতে অভিষেকের প্রায় সাত মাস পর ২০০৭ সালে টি-২০ ফরম্যাটে কেনিয়া বিশ্বকাপে ডাক পান তামিম। ওই আসরে স্বাগতিকদের বিপক্ষে অভিষেক হয় তার। কিন্তু ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ততম এই সংস্করণে অভিষেক রাঙাতে পারেননি তিনি।
এর পরের বছরই ডাবলিন টেস্টে অভিষেক হয় তামিম ইকবালের। যেখানে স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পরপর দুই ইনিংসে অর্ধশতক তুলে নেন তিনি। তাসমানিয়ার পাড়ে কিউই বোলারদের চোখ রাঙিয়ে প্রথম ইনিংসে ৫৩ এবং দ্বিতীয় ইনিংসে ৮৪ রান করে সাজঘরে ফেরেন তিনি। ম্যাচটি হারলেও তামিম নিজের সামর্থ্যের পরিচয় দিয়েছেন। একই সঙ্গে জানান দিয়েছেন টাইগার ক্রিকেটের জন্য প্রস্তত চট্টলার তরুণ তুর্কি।
তবে ক্যারিয়ারের বর্ণিল সময়ের শুরুটা হয়েছিল ক্রিকেটের মক্কা খ্যাত লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ড থেকে। ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট খেলতে নামে বাংলাদেশ। সেবার ইংলিশদের বিপক্ষে লজ্জার হার বরণ করলেও দলের সব আলো নিজের দিকে নিয়েছিলেন তামিম।
লর্ডস টেস্টে প্রথম ইনিংসে ব্যাট করে বাংলাদেশের সামনে পাহাড়সহ লিড দাঁড় করায় ইংল্যান্ড। এরপর ব্যাট করতে নেমে ইংলিশ বোলারদের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে অর্ধশতক তুলে নেন তামিম। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত পিটারসেনের দ্রুতগতির থ্রোতে সাজঘরে ফিরতে হয় তাকে। অবশ্য দ্বিতীয় ইনিংসে তিন অংকের ম্যাজিক ফিগার ছুঁতে ভুল করেননি এই ব্যাটার।
ইংল্যান্ডের দেওয়া বিশাল লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে লর্ডসে দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরির দেখা পান তামিম। যার মধ্য দিয়ে প্রথম বাংলাদেশি ব্যাটার হিসেবে ঐতিহাসিক লর্ডসের অনার্স বোর্ডে নাম ওঠে তার। আর তখনই ক্রিকেট বিশ্বকে জানান দিয়েছিলেন তামিম, ‘আমি প্রস্তুত।’ লাল-সবুজের হয়ে লড়তে এসেছি, অর্জনের ভাগ বুঝি নিতে এসেছি।
এরপর ক্যারিয়ারে নানা চড়াই উতরাই পেরিয়েছেন তামিম। বাংলাদেশ দলের বিপদে হাল ধরে হয়েছেন জয়ের নায়ক। কখনো কখনো বাজে ফর্মের কারণে হয়েছেন সমালোচিত। তবে হাল ছাড়েননি। মাথা উঁচু করে ব্যাটে শান দিয়ে এগিয়ে চলেছেন বীরদর্পে।
২০১৮ সালের এশিয়া কাপে দুঃসাহসিক এক কাণ্ড ঘটিয়ে জাতীয় বীর বনে যান তামিম। দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে এশিয়া কাপের গ্রুপ পর্বের ম্যাচে শ্রীলংকার মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। এ ম্যাচের শুরুতেই বাঁহাতের আঙুলে চোট পেয়ে মাঠ ছাড়েন তামিম। এরপর লংকানদের বিশ্বমানের বোলারদের মোকাবিলা করে ধীর গতিতে রান তুলতে থাকেন টাইগার ব্যাটাররা।
ম্যাচের ৪৬.৫ ওভারে ২২৯ রানে বিদায় নেন বাংলাদেশের শেষ ব্যাটার মুস্তাফিজুর রহমান। এরপর যখন গোটা স্টেডিয়াম পরের ইনিংসের অপেক্ষায় প্রহর গুনবেন, ঠিক এই সময় বাঁহাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে মাঠে নেমে পড়লেন তামিম। যে কাণ্ডে টাইগারদের ড্রেসিং রুম তো বটেই, একই সঙ্গে অবাক হয়েছিল গোটা ক্রিকেট বিশ্ব। তামিমের এক হাতের ব্যাটিংই যেন তাতিয়ে দিয়েছিল গোটা বাংলাদেশ টিমকে।
তামিমের ক্রিকেটীয় স্পিরিট সেদিন বাংলাদেশ দলকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। যার প্রভাব দেখা গিয়েছিল মাঠের ক্রিকেটে। ম্যাচটিতে লংকানদের ১৩৭ রানের বিশাল ব্যবধানে হারায় টাইগার বাহিনী। যে জয় টাইগার ক্রিকেটের ইতিহাসে শতাব্দীর পর শতাব্দী লেখা থাকবে। একই সঙ্গে ক্রীড়াপ্রেমীদের মুখে মুখে ফিরবে তামিম ইকবালের বীরত্বগাঁথা সেই গল্পটি।
বুধবার (৫ জুলাই) চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে আফগানিস্তানের বিপক্ষে মাঠে নামে বাংলাদেশ। এই ম্যাচে ডার্ক লুইস মেথডে (বৃষ্টি আইনে) আফগানদের কাছে ১৭ রানে হেরে যায় স্বাগতিকরা।
এই ম্যাচে শতভাগ ফিট না হয়েও মাঠে নেমেছিল তামিম। যে সিদ্ধান্তে আপত্তি জানিয়েছিলেন বোর্ড সভাপতি পাপন ও টাইগার কোচ হাথুরুসিংহে। ধারণা করা হচ্ছে, তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার জবাব হিসেবেই অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তামিম। যদিও সেই গুঞ্জনকে উড়িয়ে তামিম বলেছেন ভিন্ন কথা।
তামিম বলেন, ‘আমার মনে হয়েছে, অবসর নেয়ার জন্য এটা সঠিক সময়। আমার ক্যারিয়ারের জন্য অনেকের ধন্যবাদ প্রাপ্য। অনেককে ধন্যবাদ দিতে হবে।’
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেয়ার মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ১৬ বছরের বর্ণিল ক্যারিয়ারকে বিদায় বলে দিয়েছেন তামিম। এতে ২৪১ ম্যাচের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ৩৬.৬২ গড়ে ৮৩১৩ রান করেছেন তিনি। এই ফরম্যাটে তামিমের শতক রয়েছে ১৪টি, যেখানে অর্ধ-শতক ৫৬টি।
টেস্ট ক্রিকেটেও বাংলাদেশকে লম্বা সময় সার্ভিস দিয়েছেন তামিম। ৭০ ম্যাচে ৩৮.৮৯ গড়ে ৫১৩৪ রান করেছেন তামিম। সেঞ্চুরি ১০টি ও ফিফটি ৩১টি। এই সংস্করণে টাইগারদের পক্ষে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান ও সেঞ্চুরি করেছেন তামিম।
গত বছরের ১৬ জুলাই টি-২০ ক্রিকেটকে বিদায় বলেন তামিম। ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটটিতে ৭৪ ম্যাচে ১৭০১ রান করেছেন তামিম। টি-২০তে টাইগারদের পক্ষে একমাত্র শতক রয়েছে তামিমের। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ২৫ সেঞ্চুরি করা তামিম তিন সংস্করণ মিলিয়ে ১৫ হাজারের বেশি রান করেছেন। দেশের আর কোনো ক্রিকেটার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এত রান করতে পারেননি।
আবেগী বিদায়ে তামিম নিজে কাঁদলেন, একই সঙ্গে কোটি বাঙালি ভক্তকে কাঁদালেন। হয়তো একটা সময় আসবে যখন তামিমের গৌরবগাঁথা ক্যারিয়ারের গল্প ক্রিকেটপ্রেমীদের মুখে মুখে ফিরবে। তামিম আপনি আছেন, থাকবেন এবং রয়ে যাবেন জন্ম থেকে জন্মান্তরে।


