মো. রাফি সারোয়ার: তুষার করোনাকালীন সময়ে গাজীপুরে একটি টেক্সটাইল প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। তখন সদ্য বিয়ে করা তুষারের চাকরি হতে যে বেতন পেতেন তাতে ভালোভাবেই পরিবারের খরচ মিটে যেতো। তবে সেই ভালো থাকায় বিপত্তি ঘটলো একটি নোটিশে। তুষার বললো, অর্ডার কমে গেছে কারণ দেখিয়ে আমাকে আর না আসতে বললো।
শুধু তুষার না। জানা যায়, করোনা মহামারীর সময় একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় একশো জনকে চাকরিচ্যুত হতে হয়েছে। পুরো দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো বিবেচনা করলে তা হবে হাজারের উপরে।
তুষারের বন্ধু সিফাত পরেছে অন্য ঝামেলায়। গাজীপুরেই অন্য একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছিলো সে। জানালো, বছর শেষে যে স্যালারি ইনক্রিমেন্ট দেওয়ার কথা ছিলো তা পাচ্ছিলাম না। ভাবলাম চাকরিটা ছেড়েই দিবে।
সিফাত রিজাইন লেটার যখন জমা দিতে গেলো প্রতিষ্ঠানের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা তখন তাকে চাকরিতে থেকে যেতে বললো। বলা হলো, বেতন বাড়ানো হবে।
বেতন বাড়ানোয় প্রতিষ্ঠানটিতে সে থেকে গেলো।
তার বেতন বাড়ালেও বেতন দেওয়া নিয়ে অনেক অভিযোগ শোনা যায় প্রতিষ্ঠানটির নামে। মাঝেমধ্যে কয়েকমাস পরপর বেতন দিতেও বিলম্ব হয়।
‘এখানে আর ভালো লাগছে না, মনোযোগও দিতে পারছি না কাজে।’ সিফাত চিন্তা করছে যদি অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে আরও ভালো বেতনের সুযোগ পায় চলে যাবে।
এদিকে চাকরিচ্যুত তুষার হন্যে হয়ে চাকরি খুজছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু, বড় ভাই, পরিচিত সবাইকে বলে রাখছে চাকরির ব্যাপারে। লিংকডইনে একটা পোস্টও দিলো যেন চাকরি পায়। অন্যদিকে সিফাত বিভিন্ন চাকরি সংক্রান্ত ফেসবুক গ্রুপগুলোতে মাঝেমধ্যে চোখ রাখে যদি ভালো কোনো সুযোগ আসে, কথাও বলে রাখে তার পরিচিতদের সাথে।
তুষার ও সিফাতের মতো অনেকে এমন পরিস্থিতির স্বীকার হলেও করোনা-উত্তর সময়ে সমস্যাগুলো খানিকটা কেটে যায়।
দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি পোশাক শিল্পের সাথে দেশের প্রায় ২৫ লক্ষাধিক শ্রমজীবী মানুষ জড়িয়ে আছে। সঠিক সময়ে বেতন না দেওয়া, বেতন কম দেওয়া, সুযোগ-সুবিধার ঘাটতি, ছুটি কম পাওয়াসহ আরও অনেক আক্ষেপের কথা শুনা যায় এ শিল্পের সাথে জড়িত মানুষের সাথে কথা বলে। এ শিল্পে চাকরি করছে হাজারো প্রকৌশলী। আধুনিকায়ন ও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে টেক্সটাইল শিক্ষা নিয়ে অনেক সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কাজ করে যাচ্ছে। এতে প্রতি বছর ভর্তি হচ্ছে হাজারো শিক্ষার্থী।
বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে টেক্সটাইলের ওপর স্নাতক করার পরও অনেক শিক্ষার্থী আর এই পেশায় যুক্ত থাকছে না। তারা হয়তো উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাহিরে চলে যাচ্ছে আর না হয় অন্য পেশার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। অনেকগুলো কারণে শিক্ষার্থীরা টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিতে প্রবেশে অনীহা তৈরি হচ্ছে ।
ইমরান হক নামে এক প্রকৌশলী পাঁচ বছর যাবত একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত আছেন। তিনি জবের সিকিউরিটির প্রসঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা তাদের চাকরি ও জীবনের নিরাপত্তার জন্য অন্য পেশায় যুক্ত হচ্ছে। চিন্তা করছে বেসরকারি চাকরি যেকোনো সময় চলে যেতে পারে, এখানে জব সিকিউরিটি কম। এতে অনেকে সরকারি চাকরিকে পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছে।
অনেক শিক্ষার্থী হোয়াইট কলার জব করতে চান। কিন্তু টেক্সটাইলে প্রোডাকশন ফ্লোরে খাটুনি কিছুটা বেশি। মাঝেমধ্যে কাজের জন্য দুর্ব্যবহার সহ্য করার কথাও শোনা যায়। তাছাড়া গরম পরিবেশ ও অনেক শব্দ সেখানে৷ আবার অনেক পড়াশোনা না জানা কর্মীদের সাথেও কাজ করতে হয়।
জানা যায়, ডায়িং ও ওয়াশিংয়ের জবগুলোয় অনেক সময় মানসিক নির্যাতনেরও শিকার হতে হয়। বেসরকারি চাকরি হওয়ায় এ ধরনের চাকরিগুলোতে অনেক সময় ছুটির দিনেও ফ্যাক্টরিতে যেতে হয়। প্রতিষ্ঠানে প্রবেশের সময় নিদির্ষ্ট থাকে কিন্তু বের হবার সময় নিদির্ষ্ট না। অনেক সময় অতিরিক্ত সময়ও প্রতিষ্ঠানে কাটাতে হয়।
আবার, ফ্যাক্টরি মার্চেন্ডাইজিংয়ে যারা চাকরি করে তাদের বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে যেতে হয়। তাদের ঘুরাঘুরি অনেক বেশি করতে হয়, যা অনেকের পছন্দ না। অনেক সময় দেখা যায় ক্রেতার চাহিদা অনেক বেশি থাকায় প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক নিয়মনীতির মধ্যে চলতে হয়। এতে প্রতিষ্ঠানের চাকরিরতদের ওপর কাজের চাপ বাড়ে।
লেখক: শিক্ষার্থী , বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুটেক্স)।


