হাসান শাহরিয়ার জয়: নিজের রুমে চিরপরিচিত বিছানায় শুয়ে নির্ঝর এপাশ ওপাশ করছে। কিন্তু কোনমতেই চোখে যেন ঘুম আসছে না তাঁর। ৪ তলায় বিছানার উপর জানালা দিয়ে মৃদু চাঁদের আবছা আলো এসে পড়েছে। যেন এক স্বর্গীয় সৌন্দর্যে ভরপুর হয়ে আছে চারপাশটা! আজ রাতটুকু কাটলেই পরের দিন ভোরে তার ট্রেন।
চিরজীবনের জন্য ছাড়তে হবে তার প্রিয় ভার্সিটি, প্রিয় হল, প্রিয় রুম। যা তাকে পরম আদরে আগলে রেখেছিল সাত সাতটা বছর। কিন্তু এখন সবকিছুরই ইতি টানার সময় উপস্থিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক পদে তার চাকরিটা অবশেষে হয়েই গেল। এর আগে পর পর দু বার বেদনা বিধুর হৃদয়ে নিজের বন্ধুদের চাকরিতে ঢুকতে দেখেছে।
ফযরের নামাজের পর আবছা অন্ধকারে দু হাত তুলে এতদিন কতবার স্রষ্টাকে ডেকেছে সে! কতবার নিজের বন্ধুদের দেখে, ভালো একটা চাকরি নিয়ে হল ছাড়ার জন্য উতলা হয়ে থাকতো সে! কিন্তু চাকুরীটা হয়ে যাবার পর কিছুতেই তার রুমটি ছাড়তে আর মন চাইছে না। আজকে সকালে এম এস ডিফেন্স শেষে নিজের পরিচিতদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করেছে সে। আবার কবে, কোথায়, কার সাথে, কি অবস্থায় দেখা হবে এইটা কেউ জানে না। হয়তো কারও সাথে আর জীবনে কখনও দেখাও হয়তো হবে না।
একসাথে টং এর দোকানে আড্ডা দেওয়া, গিটার নিয়ে রেল লাইনের পাশে বসে ঝড় তোলা, বৃহস্পতিবার রাতে একসাথে কয়েকজন মিলে রান্না করা, ছোট কোন বন্ধে বন্ধুরা মিলে কোন ট্যূরে বেরিয়ে পড়া কিংবা একসাথে রাস্তার বুক কাঁপিয়ে হেঁটে চলা; এখন থেকে এ সবকিছুই শুধু সপ্ন। আহ্ রে…..
নির্ঝরের চোখ গলে অজান্তেই কয়েক ফোঁটা জল বেরিয়ে পড়লো।
নিজের পড়াশোনার খাতিরেই তাকে বাসা ছাড়তে হয়েছে অনেক আগেই,সেই ক্লাস নাইনে। তখন নিজের বাবা-মা, নিজের পরিবারকে ছেড়ে থাকতে কত কষ্ট হতো তার?
রাগে অভিমানে সে ক্লাস বাদ দিয়ে বাসায় গিয়ে থাকতো। বাবা কত যত্নে কত আদরে তাকে আবার গিয়ে রেখে আসতো! কত রাত সে একা কষ্টে কেঁদে কাটিয়েছে। তো তার তো আত্মত্যাগের শুরু ঐ হাইস্কুল জীবন থেকেই। এখন এ বয়সে এসে পুরুষ মানুষের ভেঙে পড়লে চলে ! ভাবতে ভাবতে কখন সে ঘুমিয়ে পড়েছে টেরও পায় নাই।
ঘুমের ঘোরে সপ্নে দেখলো তার বাবা মারা গেছে। সে আকস্মিকতার ভয়াবহতায় শুধু কাঁপতে লাগলো। নিজের বাবাকে সে খুব ভালোবাসতো। আজ বাবার লাশের পাশে দাঁড়িয়ে তার একটা কথাই বলার জন্য বুকটা ছটফট করছে। “বড্ড ভালোবাসি বাবা তোমায় কিন্তু কখনো বলতে পারি নাই”। চোখ গলে অশ্রু ঝরছে আর ছোটবেলার কত কথা তার মনে আসছে…
পারিবারিক জমি নিয়ে তাদের পরিবারের সাথে মির্জা পরিবারের খুব দ্বন্দ্ব। একবার সে ছোট থাকতে জমির বিবাদ মিটাতে গিয়ে অতিরিক্ত টেনশনে তার বাবা মরতে বসেছিলো। বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুধু কাতরাচ্ছিলো আর একটা কথাই বলছিলো ,” বাবা! আমি মরে গেলাম রে । মনে হয় আমার সময় হয়ে এসেছে! আমি এখনই মারা যাবো!”
বাবার একমাত্র ছেলে নির্ঝর বাবার এসব গোঙানি শুনে একবার হাতে তেল মেখে দেয় তো আর একবার পা ডলতে থাকে। মনে মনে বলতে থাকে, বাবা! তোমার কিছুই হবে না! আমি আছি তো তোমার সাথে। সেদিন রাতে সারা রাত সে বাবার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলো। তাঁর বালক মন এই ধারনা বদ্ধমূল করে নিয়েছিলো সে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকলে কোন মতেই আজরাঈল দরজা দিয়ে ঢুকতে পারবে না!
যাহোক, পরেরদিন সকাল হয়ে এলো। তার বাবার অবস্থার উন্নতি নাই। সে তাঁর বাবাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে কিন্তু তাঁর বাবা যেতে চাইছিল না। তিনি জেদ ধরে বসে আছেন যা হবার এখানেই হবে। তিনি যদি ভালো হন তবে বাসাতে এমনিই ঠিক হয়ে যাবেন।তবু ডাক্তারের কাছে যাবেন না।
পরে বহু কষ্টে তাঁকে রাজি করিয়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল সে। সেবারের মত বহু যন্ত্রনা আর প্রতিকূলতা সহ্য করে তাঁর বাবা বেঁচে গিয়েছিলেন।
সে বাসা ছেড়ে স্কুলে পড়তে শহরে গিয়ে থাকবে না।বাবা তাকে কত কষ্ট করে গিয়ে রেখে আসতো শহরে।
বাবা তাকে সব সময় বলতো, তোমাকে অনেক বড় হতে হবে আব্বু!বড় অফিসার হতে হবে। আমার মত ছোট মানুষদের, এ দেশে কোন সম্মান নাই।
তাঁর প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক, তাঁর বাবার বন্ধু সব সময় বলতেন, নির্ঝরের বাবাও ছোটবেলায় ভালো ছাত্র ছিলেন এবং তিনি আরও ভালো কিছু ডির্জাব করতেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তাঁর আর সামনের দিকে আগানো হয় নাই। তবে আমার বিশ্বাস নির্ঝরের মাধ্যমে তাঁর বাবা সেটা পুষিয়ে নিতে পারবে।
নির্ঝর আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো বাবার লাশের সামনে। যেই বটবৃক্ষটা মাথার উপর ছায়া হয়ে ছিলো আজ সেটা উপড়ে পড়লো। হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই প্রকৃতি তার রুদ্ররূপ দেখাতে শুরু করবে।
তাঁর মনে পড়লো, কয়েকদিন আগে ভার্সিটির করিডরে তাঁর এক বন্ধুর সাথে দেখা।
নির্ঝর বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলো, কি রে! কি অবস্থা?
তাঁর বন্ধু জবাব দিলো, এই তো রে আলহামদুলিল্লাহ। আমি ৪০ বিসিএসে টিকেছি। আমার জয়েনিং কালকে। তাই বউ সহ শেষ বারের মত আসছি, এভাবে তো আর কখনো আসা হবে না হয়তো।
হলে কিছু জিনিসপত্র আছে, নিয়েও যেতে হবে।
তা, তোর কি অবস্থা!
এই তো রে আছি মোটামুটি।
ওওও, তা কি করছিস এখন?
চাকরির পরীক্ষা তো দিতেই আছি বন্ধু, কিন্তু এখনও তো টিকলাম না কোথাও। কথাটা বলতে নির্ঝরের গলাটা না যতটা কেঁপে উঠলো , তাঁর চেয়ে আরও করুণ,ফ্যাকাসে হয়ে গেল নির্ঝরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তার হবু বাগদত্তার যার সাথে সামনেই বিবাহ হতে যাচ্ছে নির্ঝরের।
নির্ঝরের হবু বাগদত্তা খুব স্বাধীনচেতা আর উচ্চ পার্সোনালিটি সম্পন্ন। অন্যের সামনে দাঁড়িয়ে তার হবু স্বামীর করূন স্বরের ব্যর্থতার কথায় তাঁর নিজের মনে খুব কষ্ট লাগলো।
ঈষৎ অন্ধকারে নির্ঝর শুধু দেখলো তার হবু বউ মাথা নিচু করে আছে এবং এই অন্ধকারেও তার চোখের ছলছল চাহনি নির্ঝরের দৃষ্টি এড়ালো না।
অন্যের সামনে নিজের হবু স্বামীর সফলতা নিয়ে গর্ব করার অধিকার থেকে কি সে তার হবু বউকে বঞ্চিত করছে না? সে নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করলো।
হঠাৎ গোঙানির মত আওয়াজ করে নির্ঝরের ঘুম গেলো ভেঙে। তাঁর সারা শরীর ঘেমে ভিজে গেছে। টেবিলের উপরে থাকা বোতলটা থেকে পানি নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেলো সে।
কি সব উল্টাপাল্টা সপ্ন দেখলাম,হ্যাঁ! হায় ঈশ্বর, হায় ঈশ্বর! কি খারাপ সপ্ন ছিল এটা , হ্যাঁ ।বলতে বলতেই তার বাসা থেকে ফোন আসলো !
চমকে উঠলো সে । হায় আল্লাহ, কোন খারাপ খবর নাকি ? কাঁপা হাতে ফোন ধরলো সে, আর ব্যাপক উত্তেজনায় হ্যালো বলতে গিয়ে কাঁপা স্বরে বলে ফেললো, ক্যালো….
ওপাশ থেকে দরাজ গলায় ভেসে আসলো, কি রে আব্বা! এখনো উঠিস নাই। ওঠ তাড়াতাড়ি। আজকে না তোর জয়েনিং, ঢাকা যেতে হবে।
ওর মা এবার ওর বাবার পাশে থেকে বড় গলায় বলে উঠলো, একবার সকালে তোকে ফোন দেওয়া হয় নাই ঐ দিন তুই ঘুম থেকে ওঠার অভাবে পরীক্ষা মিস করছিলি। তাঁর পর থেকে আমার সব বোঝা হয়ে গেছে। তুই নিজের গরজে কোন কিছু করতি না!
তোমাকে সব সময় সব বলে দিতে হয়। তুমি খাবা না সেটাও মুখে তুলে খাইয়ে দিতে হবে, তোমার পোশাক ধুয়ে দিতে হবে আবার তুমি হলে ঘুমিয়ে ক্লাস, পরীক্ষা মিস করবে সেটাও কি আমার দেখা লাগবে?
ওঠ তাড়াতাড়ি!
ওপাশ থেকে তার বাবা হেসে উঠলো। কিন্তু এই হাসির ভেতরে নির্ঝর যে কতটা তৃপ্ততা পেলো তা সে বলে বোঝাতে পারবে না।
আলহামদুলিল্লাহ। বাবার কিছুই হয় নাই, সব ঠিক আছে তাহলে। ফোন রাখতেই তার হবু বাগদত্তার ফোন এলো। ওপাশ থেকে বলে উঠলো, আজকে তোমার জয়েনিং তাই মাস্ট ফযরের নামাজ পড়ে বের হবা। কোন ভালো কাজের আগে সৃষ্টিকর্তার শোকরিয়া আদায় করতে হয়। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। ওঠো এবার …
নির্ঝর বলে উঠলো, হ্যাঁ উঠেছি , বাবা ফোন দিয়েছিলো একটু আগে।
তারপর কিছুক্ষণ আর কেউই কথা বললো না। শুধুই ফোনটা কানে ধরে নিয়ে ছিলো। কথাও হয় না আবার কেউ ফোনটা কাটেও না …
ভোরবেলার নি:স্তব্ধ আবহাওয়ায় দুটি প্রাণীর ঈষৎ শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ প্রকৃতিকে যেন আরও ব্যাকুল করে তুললো।
অসীম অনন্তকাল পরে আড়ষ্ঠতা ভেঙে নির্ঝর ছোট গলায় বলে উঠলো,
তোমাকে খুব মিস করছি বেবি …
ওপাশ থেকে কাঁপা কাঁপা স্বরে এক স্বর্গীয় নারী কন্ঠ যোগ করলো ,
মিস ইউ টু ডেয়ার …উমমমমম মা।।।।।।।
তাঁদের এই কথোপকথনের আবেগে মনে হলো ফোনটা যেন জ্যান্ত হয়ে উঠেছে ….
লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
সংবাদ লাইভ/ সাহিত্য


