মতিউর রহমান সুমন : গফরগাঁও একটা উপজেলা। ইহা কোন জেলা নয়। অথচ পুরো বাংলাদেশের প্রায় সকলেই যেন একনামে চিনে গফরগাঁও। একটা উপজেলা হওয়া সত্ত্বেও এর এতো খ্যাতি-বিখ্যাতি, নাম-ডাক কেন। আমার মতে অনেকেরই মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগে কেন? বর্তমানের কোন ঘটন-অঘটন তো তেমন চোখে পড়ে না। বর্তমানে গফরগাঁওয়ে যতটা ঘটনা পত্রিকায় কিংবা থানার রেকর্ডে পাওয়া যায় তারচেয়ে কয়েকগুণ বেশি ঘটনা অন্যান্য বহু জায়গায় রয়েছে। এর মানে অতীতে এমন কিছু নিশ্চয় ঘটেছিলো যা দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো যা লোকমুখে এভাবে আজও গফরগাঁও দুর্ধর্ষ হিসেবে পরিচিত। যদিও গফরগাঁও মানুষের অমায়িক ব্যবহার বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষদের আকৃষ্ট করে। অসংখ্য জ্ঞানী-গুনি কবি-সাহিতিকি, রাজনীতিবিদ, সুফি -সাধক মনীষীর জন্ম এই গফরগাঁও অঞ্চলে।
তা সত্ত্বেও গফরগাঁওয়ের লোকজন দুর্ধর্ষ প্রায়ই এই বিশেষণে তারা আখ্যায়িত হয়ে থাকে। এর মূল কারণ ইতিহাস ঘেটে জানা যায়- এ অঞ্চলের কোন কোন জমিদারের এলাকায় মূল জমির খাজনা এবং অন্যান্যা কর দেওয়া ছাড়াও প্রজাদেরকে বিভিন্ন রকমের আবওয়াব, তহুরা, মাথট, নজর ইত্যাদি দিতে হত, এবং পূজা-পার্বন উপলক্ষে পাঁঠা, কলার পাত, মানকচু, উলকঁচু সরবরাহ করতে হত। উল্লেখিত কারণ সমূহের সূত্র ধরে অনেক সময় জমিদারদের মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি প্রজাদিগকে তাদের অধিকার রক্ষা করে সংগ্রামী করে তোলে। এই প্রসঙ্গে কয়েকটা দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যায়।
জয়দেবপুর রাজাবাড়িতে পূজা উপলক্ষে কলার পাত সরবরাহ করা নিয়ে স্থানীয় প্রজা এবং জমিদারের আমলা এবং পাইকদের সাথে এক সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। এই অন্যায়- অবিচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বনগাঁওয়ের মরহুম হুরমতউল্লাহ মুন্সী। বহুলোকজন নিয়ে মিছিল করে তিনি হাজির হয়েছিলেন জয়দেবপুর রাজবাড়িতে এবং শেষ পর্যন্ত তাদের অভিযোগের প্রতিকার বিধান করতে রাজা বাধ্য হয়েছিলেন।
অপর একটি ঘটনা ঘটেছিলো, যার সাথে জড়িত রয়েছে বিখ্যাত জন্মেজয়ের বিখ্যাত বাবুর বাজার ভেঙ্গে দেওয়ার ইতিহাস। ইদু নামে জনৈক মুসলমানের দাড়ির অপমান করা হলে সমগ্র মুসলমান প্রজাদের মাঝে এক বিপ্লবী চেতনাবোধ জেগে উঠেছিল। মুসলমান প্রজাগণ বিপিন বাবুর বাজারে বেচা-কেনা বন্ধ করে দিয়েছিলো। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সালটিয়ার মৌলবি নাজিরউদ্দীন সাহেব। এই উপলক্ষে এক ধর্মসভা আহ্বান করা হয়েছিলো। উক্ত সভার সভাপতি ছিলেন জৌনপুরের মৌলানা কেরামত আলী সাহেবের অন্যতম প্রধান শিষ্য মৌলানা আব্দুল বাতেন জৌনপুরী সাহেব। এই আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে, জন্ম নিয়েছিলো সুপরিচিত বাতেনীতা মাদ্রাসা। উক্ত বাতেনীয়া মাদ্রাসার প্রধান হিসাবে জনাব নাজিরউদ্দীন সাহেব আজীবন কাজ করে গিয়েছেন। বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে জমিদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন হাফেজ ফজলুর রহমান রনভাওয়ালী এবং মৌলানা ছফির উদ্দীন। জমিদার বিরোধী আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করেছিলো মৌলানা শামসুল হুদা পাঁচবাগী (রহ.) এর হাতে। ১৯৩৪-৩৫ সনে ধারাবাহিকভাবে তিনি জমিদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যান। তৎকালে জমিদারগণ বাজারে বেচা-কেনার জন্য আনীত পাটের উপর মনপ্রতি দুই আনা করে খাজনা ধার্য করলে জনসাধারণ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। মৌলানা সাহেবের নেতৃত্বে এ বিক্ষোভ গণ-আন্দোলনের রুপ ধারণ করে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে জনসাধারণ বাজারে যাওয়া থেকে বিরত হওয়ায় হোসেনপুর বাজার ভেঙ্গে যায়। ফলে আঠারবাড়ীর জমিদারের সাথে তাঁর এক দীর্ঘ মামলার সূত্রপাত হয়। আন্দোলনের এই পথ ধরে সৃষ্টি হয় গফরগাঁওয়ের কৃষক বিপ্লবের। নীলকরদের জুলুম এই এলাকার জনসাধারণকে জীবন-যুদ্ধে আরো দৃঢ় করেছিলো।
সালটিয়া বাজারের নিকটেই ছিল নীলকুঠি। কুঠিয়াল ওয়াট সাহেবের দেওয়ান নীল চাষের জন্য উৎকৃষ্ট জমিতে দাগ কেটে দিত। এই নীলচাষ নিয়ে নীলকরদের সাথে প্রজাদের প্রায়ই সংঘর্ষ হত। তাছাড়া ব্রহ্মপুত্র নদে রয়েছে বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল। প্রত্যেক জমিদার তার দখল কায়েম রাখার জন্য লাঠিয়াল নিয়োজিত রাখতো। চর দখল নিয়ে বিভিন্ন জমিদারদের লাঠিয়ালদের মধ্যে দাঙ্গা ছিলো একটি সাধারণ ব্যাপার।
উল্লেখিত বিভিন্ন অবস্থার প্রতিকূল পরিবেশ এই অঞ্চলের লোকজনকে সংগ্রামী জীবনে অভ্যস্ত করে তোলে। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাইরে সংঘটিত অনেক দুর্ঘটনা ঢালাওভাবে গফরগাঁওয়ের লোকজনের উপর চাপানো হয়ে থাকে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, এই সমস্ত অধিকাংশ দুর্ঘটনায় এই অঞ্চলের লোকজন মোটেই জড়িত নয়। বাইরের বিভিন্ন ঘটনা নির্বিবাদে গফরগাঁওয়ের লোকজনের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। সত্যিকার অর্থে অতীত এবং বর্তমানে- ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনে অন্যান্য এলাকার লোকজন অপেক্ষা তারা অধিকতর সদালাপী, অতিথি বৎসল এবং পরোপকারী। প্রায় প্রতিটি গ্রামেই বহু উচ্চ শিক্ষিত এবং উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মচারী রয়েছেন। এই এলাকার শিক্ষিতের হার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এর যথার্থতা প্রমাণ করে।
লেখক: ব্যাংক কর্মকর্তা


