অধ্যাপক ড. মো. আনিসুজ্জামান: পৃথিবী জুড়ে চলমান অর্থনৈতিক মন্দা, যুদ্ধের দামামা, মহামারীর ভয়াল থাবা, জলবায়ুর বিরূপতা, জ্বালানির সংকট ও ডলারের আকাশচুম্বীতার মাঝেও বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশেষ করে কৃষি অর্থনীতি যেভাবে তার নিজস্ব গতি বজায় রেখে চলছে, সেজন্য এই উন্নয়নের নৌকার কর্ণধার বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূয়সী প্রশংসা করতেই হয়। সেই সঙ্গে বাংলার পরিশ্রমী কৃষক, খেটে খাওয়া মানুষ, শ্রমিক, দিন মজুর, আপামর কর্মঠ জনতাও সম ধন্যবাদ প্রাপ্য।
ক্ষমতায় আসার পর হতে আওয়ামী সরকারকে শুধু বৈশ্বিক এই প্রতিবন্ধকতা গুলোরই সম্মুখীন হতে হচ্ছে না, বরং সরকারকে প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হচ্ছে অভ্যন্তরীন সমস্যারও। এর মধ্যে অন্যতম অভ্যন্তরীণ সমস্যা হল ২০১৪-১৫ সালের বিএনপি-জামায়াতের অগ্নি অবরোধ, পরর্তীতে করোনার আক্রমণ এবং সর্বশেষ আবারো বিএনপি-জামায়াতের অগ্নি সন্ত্রাস। কিন্তু এত বাঁধার পরও বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা মাথা নোয়াবার নয়।
অবরোধের কারণে সারা দেশব্যাপী কৃষি ও খাদ্যে মূলত তৈরি হয়েছে পঞ্চমুখী সমস্যা – সার ও জ্বালানীর অপার্যপ্ততা, কৃষক প্রান্তে পড়তি মূল্য, পরিবহনে প্রতিবন্ধকতা, গুদামে পন্য পচন ও দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঘোড়া। যার ক্ষতি বইতে হচ্ছে সর্বোপরি কৃষক, মজুর, মধ্যবিত্ত ও পরিবহন চালকদের। অথচ এই মেহনতি মানুষের আয়ের পথকে রুদ্ধ করে ক্ষমতায় আসার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিরোধীদলটি।
অবরোধে সারা দেশ হতে মন্থর হয়ে গেছে কৃষি পণ্যের পরিবহন। এতে সবচেয়ে ক্ষতির সম্মুখীন দেশের সবজি ব্যবসায়ীরা। চট্টগ্রাম বন্দর হতে ঢাকার কাভার্ড ব্যানের ভাড়া দুই হাজার হতে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার টাকায়। উত্তরবংগ হতে এই ভাড়া অবরোধে হয়েছে দশ হাজার প্রায়। গড়ে পরিবহন বাহনের ভাড়া বেড়েছে ৭০ শতাংশ।
ধান, সবজি, দুধ, ফলমূলসহ অন্যান্য পণ্য বিক্রি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। চাতকের মত তাকিয়ে থেকে কালে ভাদ্রে কৃষকরা পাচ্ছে ক্রেতাদের দেখা। একদিকে সদ্য তোলা আমন ধান যেমন বিক্রি করতে পারছেন না কৃষকেরা অন্যদিকে অর্থ ও সারের অভাবে ব্যর্থ হচ্ছে বোরো ধানের চারা রোপনে। সরকারী গুদামে প্রতি মণ আমন ধানের জন্য এক ডজন একশ টাকার নোট পেলেও সেই ধানের জন্য কৃষক বাজারে পাচ্ছে মাত্র দু হালি একশো টাকার নোট। দেশের প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ চালকলগুলোও চালাতে পারছে না তাদের কার্যক্রম।
এদিকে খুলনার ডুমুরিয়ার সবজি ব্যবসায়ীরা পরিস্থিতির শিকারে ক্রন্দনরত দিন কাটাচ্ছে। বগুড়ার মহাস্থানঘাট সবজি বাজারও আছে থমকে। ঈশ্বরদীর দৈনিক ১০ কোটি টাকার কৃষি পণ্য কেনা বেচাও হচ্ছে না আর। কৃষিবিভাগের এক হিসাবে এবার রাজশাহীর গোদাগাড়িতে সাড়ে তিন হাজার হেক্টর জমিতে আগাম টোমেটো চাষ করে কৃষকেরা। কিন্তু এই হরতাল অবরোধের মৌসুমে কৃষকেরা বিক্রি করেতে পেরেছে মাত্র ১০০ কোটি টাকার টমেটো যেখানে প্রতি বছর এমন মৌসুমে বিক্রি হয় প্রায় ৪০০ কোটি টাকার মতো টমেটো। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানাচ্ছে যে, দেশে এবার বিপুল পরিমাণ পেঁপে উৎপাদন হলেও অবরোধে পরিবহনের অভাবে বাগানেই পঁচে যাচ্ছে অধিকাংশ পেঁপে। এছাড়াও ৪০ টাকার পেঁপে বিক্রি হচ্ছে অর্ধেকেরও কম দামে। এমনভাবে বগুড়া, রংপুর, জয়পুরহাট, নাটোর, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, নরসিংদী, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, জামালপুর, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, শরীয়তপুর, বরিশাল, তথাপি সারা দেশের সবজি বাজারগুলোই পোহাচ্ছে একই ধরনের দুর্ভোগ। যার ফলে প্রধান শহরগুলোতে সবজিসহ অন্যান্য সকল পণ্যের দাম হয়ে উঠছে লাগামছাড়া।
আমনের ফসল উঠিয়ে কৃষক যখন তার অবারিত ক্ষেত বোর ধানে ভরিয়ে ফেলার স্বপ্ন বুনছিল ঠিক তখনই অবান্তর অবরোধ-হরতালের কারণে বিসিআইসি কৃষকদের জানান দিল স্বপ্ন ভংগের দুঃসংবাদটি। অবরোধের কারণে কৃষকদের কাছে সময়মতো পর্যাপ্ত সার সরবরাহ করতে পারছে না সংস্থাটি। সারাদেশে এই নভেম্বর থেকে মার্চের বোর ধানের মৌসুমে ইউরিয়ার প্রয়োজন হয় প্রায় ১৭ লাখ টনের। পিক সিজনে দৈনিক প্রায় ১৮ থেকে ২০ হাজার টন সার সরবরাহের জন্য প্রয়োজন পড়ে প্রায় ৯ শ থেকে ১ হাজার ট্রাক। কিন্তু আগুন সন্ত্রাসীদের আগুন খেলায় বাধাগ্রস্থ হচ্ছে এই সরবরাহ। সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ি নৌবন্দরে খোলা আসমানের নিচে পড়ে আছে হাজার টনের উপর ইউরিয়া সার। উত্তরবংগের ১৬ টি জেলার কৃষকেরা বঞ্চিত হচ্ছে এই সার হতে শুধুমাত্র অবরোধের কারনে। শুধু সারই নয় চাষের জন্য প্রয়োজনীয় বীজ, বালাইনাশক ও জ্বালানী পরিবহনও ব্যহত হচ্ছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের তথ্য মতে চট্রগ্রামের পতেঙ্গায় অবস্থিত দেশের প্রধান তেলের ডিপো থেকে অবরোধের কারণে দৈনিক তেল সরবরাহ বিঘ্নিত হয় প্রায় ১৬ থেকে ১৮ হাজার মেট্রিক টন। হাঁস-মুরগীর খামারীরাও ভাল নেই হরতাল অবরোধে। পচনশীল হওয়ায় প্রায় কোটি ছাড়িয়ে যাওয়া কর্মসংস্থানের এই খাতে অবরোধে দৈনিক ক্ষতি হয় প্রায় ২০-২৫ কোটি টাকা।
এরপরেও সরকার সকল প্রতিকূলতাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার আপ্রান চেষ্টা চালাচ্ছে। স্বস্তির বিষয় হচ্ছে এই চেষ্টায় সরকার পাশে পাচ্ছে দেশের আপামর জনসাধারণকে।
লেখক: অধ্যাপক ও প্রক্টর, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়


